মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন: রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ

জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরকরণ, বাড়ি-ঘর ও দোকানে লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ১৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে খুলনায় রাজাকার বাহিনী প্রতিষ্ঠা, ডা. মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সকল সহযোগী বাহিনীকে নেতৃত্ব দানের কারণে তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্ব) দায়েও। সোমবার এ কে এম ইউসুফ নামে বেশি পরিচিত এই জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে তাকে গ্রেফতারের আবেদন জানানোর জন্য প্রসিকিউশন টিমকে অনুরোধও জানিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। সোমবার দুপুর ৩টায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান তদন্ত সংস্থা। তদন্ত সংস্থার রাজধানীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে আয়োজিত এ ব্রিফিংয়ে উপস্থিত থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন ও বিভিন্ন প্রশ্নের দেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ হেলাল উদ্দিন ও তদন্ত সংস্থার সদস্য মোঃ নূরুল ইসলাম।তদন্ত সংস্থা জানান, এ কে এম ইউসুফের বিরুদ্ধে গত বছরের ২২ জানুয়ারি থেকে শুরু করে রোববার পর্যন্ত তদন্ত করে ১১১ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ হেলাল উদ্দিন। এর সঙ্গে ৭০ খণ্ডে ২৩৪৬ পৃষ্ঠার ডকুমেন্টস দেওয়া হয়েছে। এতে ইউসুফের বিরুদ্ধে আনা ১৫টি অভিযোগে আনুমানিক ৭০০ জনকে গণহত্যা, ৮ জনকে হত্যা, হিন্দু সম্প্রদায়ের আনুমানিক ২০০ জনকে ধর্মান্তরকরণ, আনুমানিক ৩০০ বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করা এবং প্রায় ৪০০ দোকান লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ইউসুফের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৬ জন সাক্ষীসহ ৭১ জন সাক্ষী করা হয়েছে।তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ হেলাল উদ্দিন বলেন, “জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির একে এম ইউসুফের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা কয়েক দফায় বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় সরজমিনে তদন্ত করেছেন। তারা শহীদদের পরিবারের সদস্য, মামলার বাদী ও বিভিন্ন সাক্ষীদের জবানবন্দি করে এবং বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। তদন্তকালে যেসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তার ওপর ভিত্তি করে তদন্ত কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ কে এম ইউসুফের নেতৃত্বে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়।” তিনি বলেন, “ইউসুফের নেতৃত্বে বাগেরহাট জেলার কচুয়া, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, রামপাল ও সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তরকরণ, অগ্নিসংযোগ, বাড়িঘর লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালানো হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে ইউসুফের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ আনা হয়েছে। এ কে এম ইউসুফ তালিকাভুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে একজন।”তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, শান্তি কমিটির খুলনা জেলার চেয়ারম্যান এবং মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য ইউসুফের বিরুদ্ধে খুলনায় গণহত্যা, হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে নেতৃত্বে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্ব পালনেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। ডা. মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা ও যুদ্ধপরাধে সক্রিয় সহযোগিতা দেন। এছাড়া খুলনায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীসহ পাকিস্তানি বাহিনীর সকল সহযোগী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তিনি। এ কারণে তার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্ব) অভিযোগও আনা হয়েছে।
 প্রেস ব্রিফিংয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, “১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দালালি করার দায়ে মুক্তিযুদ্ধের পর দালাল আইনে এ কে এম ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে দ্রুত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন করে ট্রাইব্যুনালে দাখিল এবং ইউসুফকে গ্রেফতারের আবেদন জানানো হয়েছে প্রসিকিউশন টিমকে। আমরা প্রসিকিউশনকে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্ব) অভিযোগ আনারও অনুরোধ জানিয়েছি।”ইউসুফের অবস্থান ও গ্রেফতার সম্পর্কে তদন্ত সংস্থার সদস্যরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, “বিষয়টি আমাদের নয়। তবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি বাংলাদেশেই আছেন। সকল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে অ্যালার্ট করা আছে। সীমান্ত এলাকা ও বিমানবন্দরেও নজরদারি রাখা হয়েছে, যেন তিনি পালিয়ে যেতে না পারেন।”    সূত্র জানায়, বর্তমানে স্থায়ীভাবে রাজধানীতে বসবাসকারী ইউসুফ বার্ধক্যজনিত কারণে শর্যাশায়ী। তার ঢাকার বাসায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে৷ উল্লেখ্য, এর আগে জামায়াতের সাবেক-বর্তমান ৯ শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতারের পর তাদের ৪ জনের বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে, বিচার চলছে ২ জনের ও তদন্ত চলছে আরো ৩ জনের বিরুদ্ধে। জামায়াতের ১০ম শীর্ষ নেতা হিসেবে যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে ইউসুফকে। এছাড়া বিচার শেষ হয়েছে সাবেক এক জামায়াত নেতার, বিচার চলছে বিএনপির সাবেক-বর্তমান দুই নেতার আর তদন্তাধীন রয়েছে আরও ৬ জনের মামলা। শেষোক্ত ৯ জনের মধ্যে পলাতক ১ জন আর আটক রয়েছেন ৪ জন।    চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউসুফের বাড়ি বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার রাজৈর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মুন্সি আজিম উদ্দিনের পুত্র৷ পাকিস্তানি আমলে খুলনা শহরের টুটপাড়ায় দিলখোলা রোডে এসে বসবাস শুরু করেন৷ ছাত্র জীবনে তিনি জমিয়তে তালাব-ই-আরাবিয়ার একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ সালে জামায়াতে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে খুলনা বিভাগের আমির ছিলেন। ১৯৬২ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে জামায়াতের প্রাদেশিক জয়েন্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব পান। ১৯৭১ সালে পূর্ব  পাকিস্তান জামায়াতের ডেপুটি আমির হন। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর খুলনার শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হন এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠন করেন।জামায়াতের বর্তমান সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা এ কে এম ইউসুফ একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরের এপ্রিলে ঢাকায় গঠনের পর পরই কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির নির্দেশে খুলনা জেলা শান্তি কমিটি গঠন করেন ইউসুফ। তিনি নিজেই এ কমিটির চেয়ারম্যান হন। খুলনা জেলা শান্তি কমিটির আওতায় ছিল তৎকালীন খুলনা সদর, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট মহাকুমা। পাকিস্তান অবজারভারসহ সে সময়কার পত্র-পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয়।এরপর প্রত্যেক মহাকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও জামায়াত, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোকে নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করেন ইউসুফ। এ কে এম ইউসুফ রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। রাজাকার নামটিও তার দেওয়া। একাত্তরে আনসার বিলুপ্ত করে দিয়ে তিনিই প্রথম খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন রাজাকার বাহিনী। ৯৬ জন জামায়াত কর্মীকে নিয়ে খুলনার খান জাহান আলী সড়কের একটি আনসার ক্যাম্পে ১৩ মে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বাহিনী। জামায়াতের দলীয় মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামসহ সে সময়ের সব সংবাদপত্রে এ খবর ছাপা হয়।তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউসুফের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো খুলনার নয়টি প্রধান নির্যাতন সেল। রাজাকার বাহিনীর ৯৬ ক্যাডার মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সেসব সেলে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের ওপর। সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো শহরের প্রধান চারটি স্থানে।খুলনার তৎকালীন ভূতের বাড়ি (বর্তমানে আনসার ক্যাম্পের হেড কোয়ার্টার) ছিল তার রাজাকার বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং প্রধান নির্যাতন সেল। আরও দু’টি প্রধান নির্যাতন সেল ও রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল বর্তমান শিপইয়ার্ড ও খালিশপুরে। এছাড়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মূল ক্যাম্প সার্কিট হাউস (ডাক বাংলো) এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অপর চারটি ঘাঁটি হেলিপোর্ট, নেভাল বেস, হোটেল শাহিন ও আসিয়ানা হোটেলও হয়ে উঠেছিল এই বাহিনীর নির্যাতন সেল। প্রথম তিনটি নির্যাতন সেল পরিচালিত হতো সরাসরি রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে আর পাকিস্তানি বাহিনীর অবশিষ্ট চারটি ঘাঁটি যৌথভাবে পরিচালিত হতো। অন্যদিকে ডাকবাংলোর পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দফতরেই ছিল শান্তি কমিটির সদর দফতর৷ সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক কর্ণেল শামসের রাজনৈতিক পরামর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন ইউসুফ৷ আর অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছে গঙ্গামারি, সার্কিট হাউসের পেছনে ফরেস্ট ঘাঁটি, আসিয়ানা হোটেলের সামনে ও স্টেশন রোডসহ কিছু নির্দিষ্ট স্থানে।তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ইউসুফের কথামতো খালেক মেম্বার ও আদম আলীর মতো আরো কয়েকজন রাজাকার সে সময় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পরে আরো অসংখ্য নারী-পুরুষকে হত্যা করেছে এবং নারী ধর্ষণ করেছে। রাজাকার বাহিনী গঠনের পর ইউসুফ মোরেলগঞ্জ ও শরণখোলা থেকে বহু লোককে জোর করে ধরে নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। যারা রাজি হননি, তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। অনেকের লাশও পাওয়া যায়নি। তাদেরই একজন শহীদ আবদুর রাজ্জাক। একাত্তরের আষাঢ় মাসের একদিন রাজাকার খালেক মেম্বার রাজ্জাককে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিতে বলেন। রাজ্জাক তা প্রত্যাখ্যান করলে সে মাসের ১১ তারিখ সকালে খালেক মেম্বার ও অপর রাজাকার আদম আলী পুনরায় বাসায় এসে রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যান। সেদিন সন্ধ্যায় রাজ্জাকের মা গুলজান বিবি জানতে পারেন, তার ছেলেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ছেলেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মা গুলজান বিবি রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা একেএম ইউসুফের কাছে যান এবং তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে করজোড়ে অনুরোধ জানান। সে সময় ইউসুফের সঙ্গে খালেক মেম্বারও ছিল। তারা দু’জনই জানিয়ে দেন, রাজ্জাককে ছাড়ানোর ব্যাপারে কোনো অনুরোধেও কাজ হবে না। পরে গুলজান বিবি তার ছেলেকে আর পাননি। সন্ধান পাননি লাশেরও।একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার জাতীয় পরিষদের আসনগুলো শূন্য ঘোষনা করে৷ ইউসুফ শরণখোলা এলাকা থেকে এম এন এ নির্বাচিত হন। এসব এমএনএদের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত ডা. মালেকের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় জামায়াতের দু’জন সদস্য ছিলেন। তাদের একজন এই ইউসুফ ছিলেন রাজস্ব, পূর্ত, বিদ্যুৎ ও সেচ মন্ত্রী। অপরজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আব্বাস আলী খান বেঁচে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা দু’জনসহ ওই মন্ত্রিসভার সব সদস্য গ্রেফতার হন। বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইনের অধীনে স্বাধীনতার পর আর সকলের সঙ্গে ইউসুফেরও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পত্র-পত্রিকায় সে সংবাদ ছাপা হয়। বাংলার বাণী পত্রিকায় ওই সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দালাল মন্ত্রী ইউসুফের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’।সংবাদটি থেকে জানা গেছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালালি করার অভিযোগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাসহ ৩৭ হাজার ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আদালতের রায়ে অন্য অনেকের সঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় একেএম ইউসুফের। কিন্তু পরে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় ১৯৭৩ সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তি পান ইউসুফ।তদন্ত প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আব্বাস আলী খান ও মাওলানা ইউসুফসহ মালেক মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকেরা সংবর্ধনা দেন। পরদিন দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় তা নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তাতে দেখা যায়, ওই অনুষ্ঠানে ইউসুফ বলেছিলেন, ‘যুব সমাজকে পাকিস্তান সৃষ্টির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি বলেই তারা আজ নিজেদের পাকিস্তানি ও মুসলমান পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে।’২৫ সেপ্টেম্বরের সংগ্রামের প্রথম পাতায় তেজগাঁও থানা শান্তি কমিটি মালেক মন্ত্রিসভার সদস্যদের সংবর্ধনা দিয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়। ওই খবরে দেখা যায়, এ কে এম ইউসুফ তার বক্তব্যে বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই ইসলামের দুশমনরা এর অস্তিত্ব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে এবং বিভিন্ন পন্থায় তারা এই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে।’ মার্চ মাসের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপকেও ইউসুফ এই ষড়যন্ত্রের পরিণাম বলে উল্লেখ করেন।১৮ অক্টোবর সংগ্রামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, মালেক মন্ত্রিসভার রাজস্ব মন্ত্রী ইউসুফ বলেন, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যেকোনো অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে আমাদের সাহসী জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবেন।’২৮ নভেম্বর করাচিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে ইউসুফ বলেছিলেন, ‘রাজাকাররা আমাদের বীর সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় হামলার মোকাবিলা করছে।’ তিনি রাজাকারদের হাতে আরও আধুনিক অস্ত্র দেওয়ার দাবি জানান। পরদিন ২৯ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশ হয়।এছাড়া ১০ অক্টোবর খুলনার জনসভায়, ২৬ অক্টোবর সিলেটের জনসভায়, ১২ নভেম্বর সাতক্ষীরার রাজাকার শিবির পরিদর্শনকালে এবং বিভিন্ন সময় তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এসব বক্তৃতা-বিবৃতি পরের দিন দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।এ কে এম ইউসুফ খুলনায় রাজাকার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে নেতৃত্বে দেওয়ার পাশাপাশি দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার দায়িত্বও পালন করেন।এদিকে মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলা শাঁখারিকাঠি গ্রামের ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে ওই মামলার বাদী নিমাই চদ্র দাস ও বাগেরহাট সদর উপজেলার চুলকাঠিতে গণহত্যার শিকার শহীদ সুনীল দেবনাথের স্ত্রী মীরা দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, “একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের স্বজনদের নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। এ অঞ্চলে ইউসুফের নেতৃত্বে চলে হত্যাযজ্ঞ। ইউসুফ প্রসঙ্গে বাগেরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমাণ্ডার ও সাক্ষী শাহিনুল আলম সানা বলেন, “একে এম ইউসুফ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাট-খুলনা অঞ্চলে রাজাকার বাহিনী গঠন করে কয়েক হাজার নিরীহ গ্রামবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হওয়ার মুক্তিযোদ্ধারা খুশি। এখন তারা কুখ্যাত এ যুদ্ধাপরাধীর দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন।”

শহীদদের স্বজন এবং মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ইউসুফের ফাঁসির দাবি জানান।

 

1 টি মন্তব্য: